দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল
আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা সকলেই দুনিয়ার মহব্বতে পড়ে থাকি। কিন্তু এই দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল এই কথাটা আমরা বেমালুম ভুলে গিয়ে আমাদের নফসের প্ররোচনায় পড়ে যাই। নফস আর শয়তানের পাতানো এই নিকৃষ্ট ফাঁদে আমরা প্রায় সকলেই প্রতিনিয়ত পা দেই। এই পোস্টে দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল এই বিষয়টি সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের বানী নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আর কথা না বাড়িয়ে চলুন শুরু করা যাক।
পোস্ট সুচিপত্রশুরুতেই চলুন দেখে নেয়া যাক দুনিয়ার মহব্বত সম্পর্কিত আল্লাহর বানী ও তার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাদিসগুলো
আল্লাহর বানী : দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল
দুনিয়ার মুহাব্বত সম্পর্কে কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ সুবহানা-তায়ালা অনেকগুলো আয়াত বা বানী উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
“দুনিয়ার অধিক সুখ-সম্ভগ লাভের মোহ তোমাদেরকে তার থেকে (অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়) ভুলিয়ে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও”। (সুরা : আত-তাকাসুর, আয়াত : ১ ও ২)
আরো পড়ুন : সুন্নত কাকে বলে? সহজ পাঁচটি সুন্নত, খুলে দেবে জান্নাতের দুয়ার
হাদিসের বানী : দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল
- আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, বৃদ্ধ লোকের অন্তর দুটি বিষয়ে সর্বদা যুবক থাকে একটি হলো দুনিয়ার মহব্বত অপরটি হল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। (সহিহ মিশকাত)
- হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাম কে খুতবায় বলতে শুনেছি যে, মদ হলো পাপের সমষ্টি। নারী সম্প্রদায় শয়তানের ফাঁদ। আর দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল। মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
- হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন ইহকাল পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যাচ্ছে। আর পরকাল সম্মুখে আসছে। আর তাদের প্রত্যেকটির সন্তানাদি রয়েছে। তবে তোমরা পরকালের সন্তান হও। ইহকালের সন্তান হইও না। কেননা আজ আমলের সময়। এখানে কোন হিসাব নেই। আর আগামীকাল হিসাব নিকাশ হবে। সেখানে কোন আমল নেই। (সহিহ বুখারী)
সম্পদের প্রাচুর্য আল্লাহ স্মরণ হতে গাফিল করে রাখে
সম্পদের প্রাচুর্য আল্লাহ স্মরণ হতে আমাদেরকে গাফিল করে রেখেছে। আপনার আশেপাশে খুঁজলেই হয়তো পেয়ে যাবেন, অনেক বেশি সম্পদশালী প্রাচুর্যবান লোক যারা আল্লাহর ইবাদত থেকে বঞ্চিত। সব থেকে বড় বিষয় একটি আমাদের মনে রাখতে হবে তা হলো, সম্পদ দুনিয়ার জন্য আর আমল আখেরাতের জন্য। আমরা যদি সম্পদশালী হই, তাহলে আমরা দুনিয়া পেলাম। আর যদি আমলদার হই তবে আখেরাত পেলাম। আর দুনিয়া তো খুবই ক্ষণস্থায়ী এটা আমরা সকলেই খুব ভালভাবেই জানি।তাই দুনিয়ায় সম্পদশালী ও প্রাচুর্যবান হয়ে আখেরাতের সেই চিরস্থায়ী সুখ শান্তি হারিয়ে ফেলা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিইবা হতে পারে।
আরো পড়ুন : তাসাউফ আত্মশুদ্ধি : দেহ অমর হবার উপায়
চলুন এ ব্যাপারে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একটি হাদিস শোনা যাক
“আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, সূর্য উদয় হওয়ার সাথেই সুর্যের দুপাশে দুজন ফেরেশতা, জিন ও মানুষ ছাড়া সকল সৃষ্টি জীবকে (মাখলুক) শোনানোর জন্য এ কথা ঘোষণা করেন যে, হে মানুষ সকল, তোমরা তোমাদের প্রভুর দিকে ফিরে আসো। শুনে রাখো যে, সম্পদের প্রাচুর্য আল্লাহ ও তার স্মরণ হতে গাফিল করে রাখে। প্রাচুর্যবান ও সম্পদশালী অপেক্ষা প্রয়োজন মাফিক স্বল্প সম্পদই উত্তম”। (মিশকাত শরীফ)
দুনিয়ার সম্পদ আমাদের কোন কাজে আসে না
আমরা একটি বিষয় প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করছি যে, প্রত্যেকটি মানুষ তার জীবনের প্রতিটা সময় প্রতিটা মুহূর্ত অর্থ উপার্জনের কাজে ব্যয় করে পাহাড় পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে অবশেষে তাকে খালি হাতেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। মৃত্যুর পরে তার সেই পাহাড় পরিমাণ অর্থের এক কানা-কড়িও তার জন্য কোনই কাজে আসে না। মৃত্যুর পর তার শুধু একটা জিনিসই কাজে লাগবে, আর তাহলো একমাত্র আল্লাহর জন্য করা ইবাদতগুলো। এই কথাটি আমরা স্পষ্টভাবে প্রতিনিয়ত জানার পরেও এর কোন তোয়াক্কা না করে ছুটে চলেছি সম্পদ উপার্জনে। ব্যয় করছি আমাদের মহা মূল্যবান সময়গুলো। চলুন এ সম্পর্কে একটি হাদিস শোনা যাক।
“আব্দুল্লাহ ইবনে শিখখির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন একদিন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর কাছে পৌঁছে গেলাম। তিনি তখন আত-তাকাছুর তেলাওয়াত করছিলেন। তেলাওয়াত শেষে তিনি বলেছিলেন, মানুষ বলে, আমার ধন! আমার ধন! অথচ তোমার অংশ তো ততটুকুই যতোটুকু তুমি খেয়ে শেষ করে ফেলো। অথবা পরিধান করে ছিন্ন করে দাও। অথবা সদকা করে সম্মুখে পাঠিয়ে দাও। এছাড়া যা আছে তা তোমার হাত থেকে চলে যাবে। দুনিয়ায় তুমি অপরের জন্য তা রেখে পরকালে চলে যাবে”। (সহিহ মুসলিম, তিরমিজি, সুনানে আহমদ)
আরো পড়ুন : তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব : সকল ধর্মের উৎস কোথায়
প্রিয় পাঠক, দুনিয়ার সম্পদ আমাদের যে কোন কাজে আসে না, আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলবার জন্য এই হাদিসটিই যথেষ্ট। আরেক হাদিসে এসেছে
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন আদম সন্তানের যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ একটি পাহাড় থাকে তবে সে তাতে সন্তুষ্ট হবে না। বরং দুটি পাহাড় কামনা করবে। তার মুখতো কবরের মাটি ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা ভর্তি করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে রুজু হয়, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন” (সহিহ বুখারী)
আল্লাহ তায়ালা পরকালে প্রতিটি নিয়ামতের হিসাব নিবেন
দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অজস্র নিয়ামত দান করে থাকেন। যেমন চোখ, কান, হৃদয়, মস্তিষ্ক, শান্তি, সুস্থতা, ধন-মাল, সন্তান-সন্ততি ও পরিবার পরিজন। আর দুনিয়াতে ব্যবহার্য এই সকল প্রত্যেকটি নিয়ামতের হিসাব নিকাশ পরকালে কঠিনভাবে নেয়া হবে।
আল্লাহ সুবহানাতায়ালা বলেন-
- তারপর অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে নেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে (সুরা আত-তাকাসুর : আয়াত ০৮)
- কর্ণ চক্ষু, অন্তর এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ৎ তলব করা হবে (সুরা আল ইসরা : আয়াত ৩৬)
বর্ণিত আল্লাহর এই দুটি বাণীর বিশ্লেষণে কোন কোন তাফসীর বিধগণ বলেন,আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য দুনিয়ায় বরাদ্দকৃত এ সকল নিয়ামত ব্যাপারে কেবলমাত্র কাফেরদেরকেই জিজ্ঞাসা করবেন। মুমিনরা এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন না। তবে বেশিরভাগ ওলামাগণ একমত পোষণ করে বলেন যে, শুধু কাফিররা নয় মুমিনরাও এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন। তবে শুধু জিজ্ঞাসা করা আজাবের জন্য জরুরী নয়। যারা এসব নিয়ামতকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবহার করবে তাকে প্রশ্ন করা সত্ত্বেও আজাব থেকে নিরাপদে রাখা হবে। আর যারা আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করবে বা নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবহার করবে না তারা কঠিন আজাবে পতিত হবে।
দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল
দুনিয়ার মহব্বত আমাদের পরকালীন জীবনের জন্য ভয়াবহ আকার ধারণ করে আছে। বর্তমানে ফেতনা-ফাসাদের সময় দুনিয়ার মহব্বত মুসলমানদের বিভিন্ন প্রকার গুনাহের মুল কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। সমাজে চলমান অধিকাংশ গুনাহগুলো দুনিয়ার মহব্বতের থেকে হয়ে থাকে। আখেরাতের মহব্বত বা আখেরাতের জ্ঞান অর্জনে উক্ত গুনাহগুলো থেকে আমরা বেঁচে থাকতে পারবো। হাদিসে আছে-
“আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দুনিয়া মুমিনদের জন্য জেলখানা। আর কাফিরদের জন্য জান্নাত স্বরুপ”। (সহিহ মুসলিম)
আরো পড়ুন : হালাল খাদ্য ও যিকির আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে কতটা জরুরী
উক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, মুমিনরা দুনিয়ার মহব্বত নয় বরং আখেরাতের মহাব্বতে অবিচল থাকবে। বর্তমান মুসলিম উম্মার জন্য এটা অতিব জরুরী যে, দুনিয়ার মহব্বত পরিত্যাগ করে আখিরাতের ভাবনা ভাবাই তাদের জন্য জ্ঞানের কাজ বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ যাদের প্রকৃতভাবে ভালবাসেন, পছন্দ করেন সম্পদ, প্রভাব, প্রতিপত্তি এসব তাদের জন্য নয়। সুতরাং দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল এই কথার উপর ভিত্তি করে আমাদের হায়াতে জিন্দেগি অতিবাহিত করা অত্যন্ত জরুরী।
উপসংহার : দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল
প্রিয় পাঠক, দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল বিষয়ক এই পোস্টে প্রকৃত মুসলমানদের জন্য সামান্য কিছু দিকনির্দেশনা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার বাণী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর কয়েকটি হাদিস উদ্ধৃত করে দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে। পোস্টটি ভাল লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন, কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
ফ্লোনেস্ট বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url